তিন কোটি বছরে সেই লালমাই পাহাড়,৩০ রাজার শাসন
মোঃরুবেল হোসেন খান,(লালমাই)কুমিল্লাঃ
কুমিল্লার ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক লালমাই পাহাড়। কুমিল্লা সদর, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, লালমাই ও বরুড়া উপজেলা জুড়ে এই লালমাই পাহাড়টি। কুমিল্লা শহর থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে এক র্দীঘ অনুচ্চ ও সরু পাহাড় শ্রেণি রয়েছে। তার উত্তর ভাগ ময়নামতি ও দক্ষিণভাগ লালমাই পাহাড় । উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ২০ কিলোমিটার লম্বা এবং ১ থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তর দিকের শেষ প্রান্তে রয়েছে রাণী ময়নামতি টিলা ও দক্ষিণ দিকের শেষ মাথার চন্ডীমুড়া (ছোট পাহাড় কে কুমিল্লার লোকজন মুড়া বলে)। ঢাকা- কুমিল্লা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ময়নামতি পাহাড়কে ভেদ করে চলে গেছে। এই মহাসড়কের দক্ষিণ দিকের কিছু অংশ ও উত্তরের সবটুকু অংশ নিয়ে ময়নামতি পাহাড়। ময়নামতি পাহাড়ের দক্ষিণ দিকের সবটুকুই লালমাই পাহাড়। আবার এখানে রয়েছে শাল বনসহ নানা রকমের গাছ। বিভিন্ন এলাকার লোকেরা এখানে এসে পাঁখি শিকার, ঔধষ গাছসহ এখানকার আদি মানুষরা জীবিকা নির্বাহ করে। লালমাটিতে গঠিত লালমাই পাহাড়ের বয়স প্রায় সাড়ে ৩ কোটি বছর বলে ভূত্তত্ত্ববিদরা মনে করেন।
কুমিল্লার স্থানীয় লোকেরা গল্প বা মজা করে বলে আমরা ৯৯ রাজার দেশে বসবাস করি। কথা যদিও মজা করে বলেন তারপরে লালমাই- ময়নামতির প্রায় সমস্ত এলাকা জুড়ে প্রাচীন কীর্তির যে সব নিদর্শ্ন রয়েছে তা থেকে প্রায় ৩০ রাজার বংশ পরিচয়। লালমাই-ময়নামতি সমগ্র পাহাড়ি এলাকারে অসংখ্য প্রাচীন কীর্তি ধ্বংস পাওয়া গেছে। রাণীড় পাহাড়, সেনানিবাসের হাসপাতালের পাহাড়, আনন্দ রাজার বাড়ির পাহাড়, চারপত্র মুড়া, বৈরাগী মুড়া,কোটিলা মুড়া, আদিনা মুড়া,পদুনা মুড়া, কিলা মুড়া, পাক্কামুড়া, রুপবান মুড়া, আনন্দ বিহার, ফৌজ বিহার, শালবন বিহার, কোটবাড়ি মুড়া, উজিরা মুড়া, বালাগাজী মুড়া এই ছাড়াও সর্ব দক্ষিণে চন্ডিমুড়ার স্থানে প্রচুর পরিমানের প্রাচীন কীর্তি ধংসাবশেষের চিহ্ন রয়েছে।
তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের আমলে আমাদের কুমিল্লা এই লালমাই-ময়নামতিকে রক্ষা করতে ২০ টি ধবংসাবশেষের চিহ্ন সংরক্ষণ করে।
কথিত আছে, রাম-রাবণের যুদ্ধে রামের ছোট ভাই লক্ষণ গুরুতর আহতটিহলে বৈদ্যের নির্দেশ অনুযায়ী বৈশল্যকরণী পাতার রস ক্ষতস্থানে লাগালে লক্ষণ ভালো হয়ে যাবে বলা হয়। কিন্তু বেচারা হনুমান গাছ চিনতে না পেরে হিমালয় পর্বত পুরোটা গাছ তুলে হাতে করে নিয়ে আসে। চিকিৎসার পর আবার পর্বতটা যথাস্থানে নিয়ে যেতে রওয়ানা দেন হনুমান। কিন্তু পথে পর্বতের কিছু অংশ ভেঙ্গে কুমিল্লা সংলগ্ন লমলম সাগরে পড়ে যায়। আর তখন থেকেই এ স্থানের নাম রাখা হয় লালমাই। এছাড়া শোনা যায় এক রাজার নাকি দুই মেয়ে ছিল। একজনের নাম ছিল লালমতি অন্যজনের নাম ময়নামতি। তাদের নামানুসারেই নাকি এই লালমাই ও ময়নামতি পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে।
লালমাই পাহাড়েরই একটি স্থানের নাম সালমানপুর। এই সালমানপুরেই ২০০৬ সালে চালু হয় ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় একই এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সিসিএন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটও। এখানে রয়েছে শালবন বিহার। পূর্বে এই প্রত্নস্থানটি ‘শালবন রাজাবাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। এর আসল নাম ‘ভবদেব মহাবিহার’। এই বিহারটি খননে পাওয়া গেছে বিপুল পরিমাণ প্রত্নবস্তু, যা এখন ময়নামতি জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে। রয়েছে ময়নামতি বৌদ্ধবিহার। এখানে অষ্টম শতকের পুরাকীর্তি রয়েছে।এখানকার বিভিন্ন স্পটের মধ্যে শালবন বিহার ও বৌদ্ধ বিহার অন্যতম। ৩ বৌদ্ধ বিহার থেকে ৩ মাইল উত্তরে দেখতে পাবেন কুটিলামুড়া ও রূপবান মুড়া। এরও উত্তর-পশ্চিমে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত চারপত্র মুড়া। এখানে বনবিভাগ ২টি পিকনিক স্পট চালু করেছে।
এখানেই রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড)। বার্ডের ভিতরের নয়নাভিরাম রাস্তা দিয়ে সামনে এগুলেই দেখতে পাওয়া যাবে নীলাচল পাহাড়। দু’পাহাড়ের মাঝখানে দেখতে পাওয়া যাবে অনিন্দ্যসুন্দর বনকুটির। চন্ডী মন্দিরদ্বয়ও অবস্থিত এখানে। আর এই চন্ডি মন্দিরদ্বয়ের নামানুসারে এলাকাটি চন্ডিমুড়া নামে বেশ পরিচিত।
লালমাইয়ের পাশেই রয়েছে নূরজাহান ইকো পার্ক, রাজেশপুর ফরেস্ট, সম্রাট আওরঙ্গজেবের ভাই শাহজাদা সুজার নাম অনুসারে নির্মিত শাহ সুজা বাদশাহ্ মসজিদ, রাজা ধর্মমানিক্যের খননকৃত ২৩.১৮ একর আয়তনের ধর্মসাগর, ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ময়নামতি ওয়ার সেমিট্রি, রাণীর বাংলো, ত্রিশ আউলিয়ার মাজার, নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃত নবাব ফয়জুন্নেছার বাড়ি, পাশেই রয়েছে কুমিল্লার সুখ-দুঃখ গাঁথা গোমতী নদী। এছাড়াও রয়েছে কুমিল্লা পৌর শিশু পার্ক, চিড়িয়াখানা ও ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ।