টিআইবি বন্যায় ত্রাণ বিতরণে স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক বিবেচনা
নিজস্ব প্রতিবেদক :ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলছে, চলতি বছর দেশব্যাপী বন্যায় ত্রাণ বিতরণে স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক বিবেচনাসহ অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। রোববার রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে টিআইবির কার্যালয় বন্যা ২০১৯ মোকাবেলায় প্রস্তুতি এবং ত্রাণ কার্যক্রমে শুদ্ধাচার পর্যবেক্ষণ প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানানো হয়।
পর্যবেক্ষণে টিআইবি বলছে, বন্যার ঝুঁকি যথাযথ চিহ্নিত না করা, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে উদ্যোগের ঘাটতি পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র না থাকা, মেরামতের অভাবে বাঁধ নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং বন্যা মোকাবেলায় পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ক্ষতির তুলনায় ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য অপ্রতুল সরকারি বরাদ্দ হওয়ায় প্লাবিত অসংখ্য মানুষ ত্রাণের আওতায় আসেনি। রাজনৈতিক বিবেচনায় ত্রাণ বিতরণ, স্বজনপ্রীতি, ত্রাণের চাল কম দেওয়া, একই পরিবারকে একাধিকবার ত্রাণ দেওয়া, অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ ত্রাণ থেকে বঞ্চিত করার ঘটনা ঘটেছে।
বন্যাকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় বাজেট, লোকবল, পরিকল্পনার ঘাটতি থাকায় আশ্রয়কেন্দ্রসহ অন্যান্য এলাকায় সেবা ঘাটতি রয়েছে। যেমন: চিকিৎসা, পানি স্যানিটেশন, নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষা, গবাদি প্রাণী ও গৃহস্থলি সম্পদ সুরক্ষা হয়নি।
ত্রাণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ন্যায্যতা ও জনঅংশগ্রহণের ঘাটতির পাশাপাশি বন্যা মোকাবেলায় প্রশাসনের সার্বিক তদারকিতে দুর্বলতা দেখা গেছে।
মিশ্র পদ্ধতির গবেষণায় গুণগত ও পরিমাণগত তথ্য ব্যবহারসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে টিআইবি এ গবেষণা করেছে।
এতে দেশের পাঁচটি জেলার ১০টি উপজেলা থেকে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। এরমধ্যে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, বগুড়ার সোনাতলা, সারিয়াকান্দি, সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ, গোয়াইঘাট, কুড়িগ্রামের উলিপুর চিলমারি এবং গাইবান্ধাতে সদর ও ফুলছড়ি রয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে বন্যা মোকাবেলায় সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। তবে পর্যাপ্ত ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়নি। বেসরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও) সরকার এবং নিজেদের সঙ্গে সমন্বয় ছিল না। এনজিওগুলো নিজেদের সুবিধাভোগীদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেছে।
বন্যার্তদের ত্রাণ থেকে এক মন্ত্রীর সফরে খরচ করার বিষয়ে প্রশ্ন করলে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মন্ত্রী দুর্যোগপূর্ণ এলাকা পরিদর্শন করবেন এটা রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ এবং তাদের কর্তব্য। তবে ত্রাণের বরাদ্দ থেকে মন্ত্রীর খরচ ধরা নিয়ম বহির্ভূত।
জরিপে দেখা গেছে, সরকার ঘোষিত ৪৩ শতাংশ অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে রাত্রিকালীন অবস্থান করার মতো সুযোগ সুবিধা ছিল না। ৬৫ শতাংশ আশ্রয়কেন্দ্রে নারীদের থাকার জন্য পৃথক ব্যবস্থা ছিল না। ৪১ শতাংশ আশ্রয়কেন্দ্রে টয়লেটের ব্যবস্থা ছিল না। ৭৯ শতাংশ আশ্রয়কেন্দ্রে নারীদের জন্য পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা ছিল না। ৫৩ শতাংশ আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত সুপেয় পানি ও পানি বিশুদ্ধকরণ সামগ্রীর সরবরাহ ছিল না। ৮২ শতাংশ আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত খাবার স্যালাইন ওষুধপত্র সরবরাহ ছিল না। ৮৬ শতাংশ আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত খাদ্য সামগ্রী ছিল না। ৭৬ শতাংশ এলাকায় প্লাবিত মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা ছিল না।
ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ৭৩ শতাংশ জায়গায় ত্রাণ পরিমাণে কম দেওয়া হয়েছে। ৩২ শতাংশ শতাংশ জায়গায় স্বজনপ্রীতি হয়েছে। ২৬ শতাংশ জায়গায় পরিবারের সদস্য সংখ্যা বিবেচনা না করে ত্রাণ বিতরণ হয়েছে। ২৩ শতাংশ জায়গায় রাজনৈতিক বিবেচনায় ত্রাণ বিতরণ হয়েছে।
১৭ শতাংশ জায়গায় তালিকায় না থাকার পরো অনেকে ত্রাণ পেয়েছেন। ১৭ শতাংশ জায়গায় ত্রাণ আত্মসাৎ হয়েছে। ৯ শতাংশ জায়গায় সাবাই সমান ত্রাণ পায়নি ; কোথাও পচা চাল দেওয়া হয়েছে। ৭ শতাংশ জায়গায় নিয়ম বহির্ভূত অর্থ প্রদান করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরে বন্যায় ৪০ লাখ মানুষ পানিবন্দী ছিল। মোট ক্ষতিগ্রস্থ জেলা ছিল ২৮টি। মৃত্যুর সংখ্যা ছিল সরকারি হিসেবে ১০৮জন এবং বেসরকারি হিসেবে ১১৯জন। ৯৮ হাজার পরিবার সম্পূর্ণ ও আংশিক ১৩ লাখ ৬০ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।